“কক্সবাজারকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ভাবনার। কারণ এখানে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। যে বিদেশিদের আকর্ষণ করার জন্য মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, সেই বিদেশিদেরই এখান থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে যেতে হয়েছে। ২০০৫ সালে বিদেশি নারীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, সর্বশেষ ২০১৯ সালেও অস্ট্রেলিয়ার এক নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল। কৌশলে তিনি বেঁচে যান। তারও আগে ১৯৮৭ সালে আরেক বিদেশি পর্যটক ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।”
কক্সবাজারে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় দেখে সন্দেহ হয়েছিল-নিরাপত্তা বিধান সম্ভব হবে কি এই পর্যটকদের? সেই আশঙ্কাই সত্য হলো। পর্যটননগরী (সুরক্ষিত?) কক্সবাজারে ধর্ষণের শিকার হলেন এক পর্যটক নারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছে তা নিয়ে।
স্বস্তিবোধ করছি না এই বিষয়ে লিখতে গিয়ে। কারণ এই অমানবিক ঘটনা শুধু কক্সবাজারে নয়। বাংলাদেশে যেন সংক্রামকব্যাধির মতো এর বিস্তার। আজ এই জায়গায় তো আরেকদিন আরেক জায়গায়। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু স্পর্শকাতর জায়গা আছে যেখানে এমন বিপর্যয় ঘটলে কুফলটা শুধু ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং জাতীয় স্বার্থকে নাড়া দেয়। কক্সবাজারের ঘটনাটা তেমনি। স্পষ্টত বলা যায়-কক্সবাজারে যে নারী নির্যাতনের শিকার হলেন তা আজকের বাংলাদেশই নয়, ভবিষ্যতের অর্থনীতি এবং প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নকেও আঘাত করেছে। কারণ কক্সবাজার বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির সম্ভাবনাময় দিক।
কতটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে কক্সবাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এমনও বলা হয়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প খাতের পরবর্তী জায়গাটি পর্যটন খাত সহজেই দখল করতে পারে। কক্সবাজার নিয়ে শুধু স্বপ্ন দেখাই নয়, কক্সবাজারকে আধুনিক পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বেশ কিছু উচ্চাকাক্সক্ষার মেগাপ্রকল্পও বাস্তবায়নাধীন এই মুহূর্তে। এরজন্য প্রকল্প ব্যয় দেখলেই বোঝা যায় কী হতে পারে ভবিষ্যৎ কক্সবাজার। সেখানে ব্যয় হবে ৩ লাখ কোটি টাকা। তৈরি হবে বাংলাদেশের অন্যতম বিমানবন্দর। যেখানে সমুদ্রে তৈরি রানওয়েতে বিমান নামবে আকাশ থেকে। কক্সবাজার চট্টগ্রাম রেললাইনের কাজ তো এগিয়ে চলেছে। গভীর সমুদ্রবন্দর, সোনাদিয়াতে ইকোপার্ক, আন্তর্জাতিক বিমানগুলোর জন্য রিফুয়েলিং ব্যবস্থাসহ ২৫টি মেগাপ্রকল্প এবং ৭৭টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আসলেও কক্সবাজার হবে বিশ্বের বড় বড় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর অন্যতম।
প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কক্সবাজারে যদি এভাবে ধর্ষণের শিকার হতে হয়, তাহলে উন্নয়ন বাস্তবায়ন হলেও বাংলাদেশ কি এর সুফল পাবে? এক বাক্যেই বলা যায়-না।
কক্সবাজারকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ভাবনার। কারণ এখানে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। যে বিদেশিদের আকর্ষণ করার জন্য মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, সেই বিদেশিদেরই এখান থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে যেতে হয়েছে। ২০০৫ সালে বিদেশি নারীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, সর্বশেষ ২০১৯ সালেও অস্ট্রেলিয়ার এক নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল। কৌশলে তিনি বেঁচে যান। তারও আগে ১৯৮৭ সালে আরেক বিদেশি পর্যটক ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
বাংলাদেশের নাগরিক ধর্ষণের শিকার হলেই যেখানে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাওয়ার কথা সেখানে বিদেশিদের কেউ যদি ধর্ষণের শিকার হন তাহলে ওই দেশের কোনো পর্যটক কি আসার সাহস পাবে?
প্রাসঙ্গিকভাবেই কেউ বলতে পারেন, এটা সামাজিক দুর্ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় কক্সবাজারের এই ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে। জানা যায় মূল অভিযুক্ত আশিকুল ইসলাম এর আগেও ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। শুধু তাই নয়, ৪ মাস আগে সে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে। একটি সংবাদে দেখা গেছে, এই আশিকুলের নেতৃত্বে ৩২ জনের একটি গ্রুপ সেখানে সক্রিয়। যারা নিত্য ছিনতাই ও ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত। মাদকসহ একাধিক মামলারও আসামি সে।
অভিযুক্তদের পরিচয় দেখেও বোঝা যায়, তারা সার্বক্ষণিক পুলিশের নজরদারীতে থাকার কথা। এই পর্যন্ত যে তিনজনের নাম প্রকাশ হয়েছে তাতে জানা যায় একজনের নাম গুন্ডায়া বাবু ওরফে মেহেদি হাসান, একজন গুন্ডা শফির ছেলে। আর আশিকুল তো সরাসরি জেলখাটা আসামিই। সুতরাং এই কাজ যে হুট করে করা হয়েছে তা বলার সুযোগ কম। অন্তত তাদের কর্মকা-ের সূত্রেই তাদের নামের সঙ্গে এসব বিশেষণ যুক্ত হয়েছে। তাদের গুন্ডামির চিহ্ন যেখানে নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, সেখানে তাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর না রাখার কারণ বুঝি না।
ট্যুরিস্ট পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কথা উঠেছে। পুলিশ কর্তৃপক্ষের স্থানীয় কর্মকর্তারাই বলেছেন, লাবনি পয়েন্টের মতো জায়গা থেকে এমন ঘটনা ঘটা রহস্যজনক। তাহলে কিভাবে ঘটেছে তাও তাদেরই বের করতে হবে। যদি সেখানে পুলিশ থাকে তাহলে এমন ঘটনার জন্য তাদের দায় বহন করতে হবে। যদি না থাকে তাহলে জানতে হবে কোন কারণে সেখানে পুলিশ ছিল না।
ধর্ষণের শিকার নারীর বিষয়ে পুলিশ যে ভাষ্য দিয়েছে তাও কতটা গ্রহণযোগ্য সেটাও ভাবতে হবে। তারা বলছে, এই মহিলা কয়েক মাস আগেও কক্সবাজার এসেছিল, তাই সে পর্যটক কি না ভেবে দেখতে হবে। এধরনের বক্তব্য আসলে মূল ঘটনাকে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে গণ্য হতে পারে। ট্যুরিস্ট না হলে কি একজন সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা থাকবে না?
নারী ও শিশু নির্যাতনে বিচার প্রক্রিয়া এবং শাস্তির বিষয়ে অনেক কথা হয়। দ্রুত আইনে বিচার হওয়ার কথা থাকলেও ফল খুব একটা সুবিধাজনক নয়। বিভিন্ন কারণে মামলা ঝুলে থাকা এবং অপরাধীর শাস্তি না হওয়ার কারণে নতুন অপরাধীরা অনুপ্রাণিত হয় এবং পুরনোরা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আবার অপরাধে যুক্ত হয়।
একটি পরিসংখ্যান থেকে বিচার ও শাস্তির চিত্র দেখা যাবে। বাংলা ট্রিবিউনের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়-
ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বিচারকাজ পরিচালনার জন্য ট্রাইব্যুনাল ঢাকা ১, ২, ৩, ৪, ৫ কাজ করেন। যেখানে নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল ঢাকা-১ এ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২০১৭ সালে ৬ হাজার ২২৭টি মামলা আসে। ২০২০ সালে এসেও ২ হাজার ৯০২টি মামলা পেন্ডিং রয়েছে। ঢাকা-২ এ ২০১৭ সালে মোট মামলা আসে ৫ হাজার ২৭২টি, বিচারাধীন ৯৪৭টি। একইভাবে ঢাকা-৩ এ একই বছর মামলা আসে ৫ হাজার ৯৩২টি বিচারাধীন ১ হাজার ১০৪টি। ঢাকা-৪ এ মামলা আসে ৬ হাজার ৮২৯টি, বিচারাধীন ৩ হাজার ৭২৩টি। ঢাকা-৫ এ মামলা আসে ৬ হাজার ১০১টি, বিচারাধীন ২ হাজার ৩৯৪টি মামলা।
এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় কোন কারণে বাংলাদেশে ধর্ষণের মতো অপরাধ দমন করা সম্ভব হচ্ছে না।
এই মুহূর্তে ভাবতে হবে গোটা দেশের কথা। যাতে কোথাও কক্সবাজারের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। শুধু পর্যটন কেন্দ্র নয়, স্কুল কলেজ বাস কিংবা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সব জায়গাতেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক।