কেটে রাখা পাকা ধানের উপর পানি
ন্যুইয়ে পড়েছে আধা পাকা ধান
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: কৃষকের পাকা ধানে মই দেয়ার অবস্থা হয়েছে ভারী বৃষ্টি। বৃষ্টিতে বোরো আবাদের কেটে রাখা পাকা ধানের উপর পানি উঠে যায়। আবার কোথাও আধা পাকা ধান ন্যুইয়ে পড়েছে। কষ্টের ধন শেষ মুহূর্তে এভাবে ভেসে যাওয়ায় কৃষক এখন দিশেহারা। ক্ষেতে ভেজা ধান আর কৃষকের চোখের জল একাকার। সবমিলিয়ে কৃষকের স্বপ্ন প্রায় মাঠেই মারা গেছে।
তবে কৃষি বিভাগের দাবি, বোরো ধানে এখন পর্যন্ত খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। তবে নতুন করে বৃষ্টি হলে কাটাধানে ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। দু’একদিনের মধ্যে ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে বলে জানান কৃষি বিভাগের এক উর্দ্ধতন কর্মকর্তা।
সোমবার সকাল ১১টার দিকে যশোরে বৃষ্টি শুরু হয়। টানা ভারী বৃষ্টিতে মাঠে কেটে রাখা, কোথাও বেঁধে রাখা, কোথাও জালি দিয়ে রাখা ধানের ওপর দিয়ে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অদিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক দীপঙ্কর দাশ দৈনিক কল্যাণকে জানান, সোমবারের বৃষ্টিতে জেলার বেশকিছু এলাকায় কাটাধান তলিয়ে গেছে। তবে নতুন করে বৃষ্টি না হলে ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে ৬০ ভাগ ধান কেটে ঘরে তুলতে পেরেছেন কৃষক। ৪০ ভাগ ধান ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে মাঠের চিত্র ভিন্ন।
যশোরে চলতি মৌসুমে এক লাখ ৫৮ হাজার ৮শ’ ৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে।
যশোর সদরের ফুলবাড়ির কৃষক আকতার হোসেন ও বীরনারায়নপুর গ্রামের আব্দুল মান্নান জানান, তারা এখনো ১৫ ভাগ ধান ঘরে তুলতে পারেননি। সোমবারের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে কাটাধান। ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’র প্রভাবে ধান ক্ষতির মুখে পড়তে পারে ভেবে তারাসহ এলাকার অনেকে আধা পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সব চেষ্টায় ছাই ফেলেছে সোমবারের বৃষ্টি। দিনে ৭শ টাকা দরে শ্রমিক কিনে ধান কেটেছিলেন- যোগ করেন তারা।
মণিরামপুর উপজেলার মুজগুন্নি গ্রামের কৃষাণী সাহেলা বেগম জানান, ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে তড়িঘড়ি করে ধান কেটে ঘরে তুলেছি। তবে প্রতিবেশিদের অনেকের কাটা ধান বৃষ্টির পানিতে ভাসছে। তিনি বলেন, অনেকে চোখের পানি ফেলছেন। বলছেন ধানে শ্রমিকের ঘামের দামও উঠবে না।
সদরের দেয়াড়া গ্রামের সুশান্ত দাস দৈনিক কল্যাণকে বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়। বেলা বাড়তেই মুষলধারে বৃষ্টিপাত হয়। দুপুরের দিকে বৃষ্টি কমতে থাকে কিন্তু তারআগেই হাঁটুজলে তলিয়ে যায় কাটা ধান। যেকারণে ঘরে তুলতে পারিনি ধান। তিনি বলেন, এসব ধান ক্ষেতেই ঝরে যাবে, যার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না।
চৌগাছা উপজেলার সিংহঝুলি গ্রামের আলম দফাদার বলেন, চৌদ্দ বিঘা ধান করেছি। শ্রমিক না পাওয়ায় কাটতে পারিনি। ঠাকুরগাঁও থেকে শ্রমিক এনেছি। সোমবার ধান কাটতে কাটতেই বৃষ্টিতে ভিজে সারা।
রামকৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা বাবুল আক্তার বলেন, রোববার রাতে আমি ও আমার এক ভাই দুই বিঘা ক্ষেতের ধান বেঁধে জালি দিয়েছি। এখন সেই জালির ওপর দিয়ে পানির স্রোত যাচ্ছে। জমিটি একটু নিচুতে হওয়ায় সেখানকার মাটি নরম ছিলো। সেজন্য কোনো গাড়ি না যাওয়ায় ধান বাড়ি নিতে পারিনি। তাছাড়া আবহাওয়া বার্তা ছিলো দশ তারিখের পর বৃষ্টি হবে। হঠাৎ সোমবার দিনভর যে বৃষ্টি হয়েছে তাতে উপজেলার কমবেশি সকল কৃষকেরই ক্ষতি হয়েছে।
কৃষকরা জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের টানা বর্ষণে বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বোরো ধান চাষ প্রায় একমাস পিছিয়ে যায়। ব্যপক ক্ষতি হয়, পেঁয়াজ, আলুসহ বিভিন্ন সবজির। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকরা বেশি জমিতে বোরো ধান চাষ করেন। ধানের ফলনও হয়েছিলো বাম্পার। তবে অসময়ের হঠাৎ এই বৃষ্টিতে কৃষকের সেই স্বপ্ন এখন মাঠেই জলে ডুবে রয়েছে।
যশোর আবহাওয়া অফিস জানায়, সোমবার ২৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। দিনে তাপমাত্রা ছিল ৩২ ডিগ্রি সেলশিয়াস। বিকেল ৫টার দিকে বাতাসের আপেক্ষিক আদ্রতা ছিল ৯৫ থেকে ৯৬ শতাংশ। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, রাতেও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চৌগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সমরেন বিশ্ব্াস বলেন, অসময়ের বৃষ্টিতে কিছুটা ক্ষতি তো হবেই। তিনি বলেন, তবে বৃষ্টি আর না হলে কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ কমবে।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক দীপঙ্কর দাশ বলেন, সব উপজেলায় মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন কৃষি কর্মকর্তারা। ক্ষয়ক্ষতির পুরো চিত্র জানা যাবে দু’একদিন পর। যেকোন দুর্যোগ মোকাবিলায় চাষীদের সতর্ক থাকতে হবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এখনও মাথায় হাত দেয়ার মতো ক্ষতি হয়নি। রাতে বৃষ্টি না হলে সকালেই ক্ষেতের কাটাধান ডাঙায় তুলে নিতে হবে। তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
রাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মণিরামপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টির পানিতে কৃষকের কাটা ধান তলিয়ে গেছে। দিন-রাত পরিশ্রম করে কৃষকেরা সোনালী বোরো ধান ফলিয়েছেন। সে ধান ঘরে তুলতে গিয়ে বৃষ্টির পানি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষকরা বলেন, উৎপাদন খরচ বাদে বৃষ্টির কারণে এক বিঘা জমির ধান ঘরে তুলতে অতিরিক্ত ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হবে। মণপ্রতি ১২ থেকে ১৩শ’ টাকা ধান বিক্রি করতে না পারলে কৃষকের লোকসান হবে।
বাগআঁচড়া প্রতিনিধি জানান, বাগআঁচড়ায় বোরো ধান ঘরে তুলতে না পেরে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন অনেক কৃষক। ফলন ভালো হলেও আবহাওয়া পরিস্থিতি ও শ্রমিক সংকটের কারণে সঠিক সময়ে ধান কাটতে না পেরে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। আর সোমবারের বৃষ্টিতে মলিন হয়ে গেছে তাদের মুখ। মুষল ধারে বৃষ্টিতে পানির নিচে তলিয়ে গেছে কৃষকের শত শত বিঘা বোরো ধান। সেই সাথে তলিয়ে গেছে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন।