আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বৃহত্তর গণহত্যা, সম্ভ্রমহানি আর সম্পদ ধ্বংসের নারকীয় তান্ডবের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিষয় হলো স্বাধীনতার সূর্যটি যখন পূব আকাশে উঁকি দিচ্ছিল ঠিক তখনই দেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে ১৯৭১ সালের আজকের দিনে তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে যে নৃশংসতা হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের পদলেহী দোসর আলবদর, আলশামস ও রাজাকাররা চালিয়েছিল, যুদ্ধে চরম পরাজয়ের পর পালিয়ে যাবার সময়ও তারা সেই নেশায় মত্ত ছিল। তাদের সেই রক্তভুক চরিত্র থেকে একটুও সরতে না পেরে এ দেশের কৃতী সন্তান প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের তারা হত্যা করে। জাতি যখন স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেলিত, খুশীর বন্যায় সবাই রাজধানী ঢাকায় ঢুকছিল তখন ঢাকার রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে তাদের লাশ পাওয়া যায়। তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ শোকাভিভুত করে তোলে আপনজনসহ সকলকে। ঘাতকরা সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশটাকে মেধাশূন্য করার হীন উদ্দেশ্যে এই ঘৃণ্য হত্যাকা- চালায়।
রক্ত দিয়ে যে জাতি স্বাধীনতা কেনে সে জাতি কখনই পরাজিত হয় না। চক্রান্তকারীরা তাদের কুটিল জাল বিস্তৃত করে আদর্শ বাস্তবায়ন বিলম্বিত করতে পারে; কিন্তু বিলুপ্তি ঘটাতে পারে না। বাঙালি জাতি স্বাধীনতা লাভের পর ৪৬ বছরে এ কথার প্রমাণ রেখেছে। বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিভূ ছিলেন হায়েনার নিষ্ঠুর ছোবলে জাতির মাঝ থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই সূর্য সন্তানরা। তারাও একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রগতিশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন লালন করতেন। পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা ভেবেছিল এদেরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলে দেশ মেধা সংকটে পড়বে। বঙ্গবন্ধুর সব স্বপ্ন, সব পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখবে না। কিন্তু স্বপ্নের বিলুপ্তি ঘটেনি। সেই বাধা অপসারিত হয়েছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আজ অগ্রসরমান। হেলাফেলা, উদাসিনতা, অবহেলা, বিভেদ আর সংকীর্ণ স্বার্থের খেলায় যেন আমাদের অগ্রসরমান গতি কোন ক্রমেই থেমে না যায়। অপশক্তি সমাজের ভেতর ঘাপটি মেরে আছে। অনেক সময় ছদ্মবেশ ধারণ করে দল বা সরকারের কাছাকাছিও থাকে। ঘাপটি মেরে থাকা এ অপশক্তিকে চিনতে হবে, তাদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে হবে যাতে তারা আবারও ছোবল মারার সুযোগ না পায়।
যারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল তারাই যে এ হত্যাকা-ের সাথে তা জড়িত ছিল আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট। স্বাধীনতা লাভের পর প্রায় অর্ধ শতাব্দি পুরতে গেল কিন্তু এই অপশক্তি দেশটাকে মেনে নিতে পারলো না। দেশের রাজনীতির ভিত্তি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, উদার অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র। ঘাতকরা মুক্তিযুদ্ধের শত্রু, মানবতার শত্রু। তারা মুক্তিযুদ্ধ ও মানবিকতাকে ধ্বংস করতে চায়। প্রগতির চাকাকে ঘোরাতে চায় পেছনে। তাদের মনে সুস্থ সুন্দর মুক্ত চিন্তার কোন স্থান নেই। তাই তো একাত্তরের ধারাবাহিকতায় আজও তাদেরকে দেশের কৃষ্টি কালচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখা যায়। এ অপশক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিত সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই।
এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সেই অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হবার দৃঢ় অঙ্গিকার উচ্চারিত হোক। অতীতের ভুল-ভ্রান্তি, ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো ঝেড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করার শপথ উচ্চারিত হোক। যারা দেশের চালিকাশক্তি মেধাবীদেরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল তাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ লড়াইয়ের বিকল্প নেই।