সাজেদ রহমান
ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে যশোর অঞ্চলে যুদ্ধ পরিস্থিতি মারাত্মক অকার ধারণ করে। ভারতীয় মিত্র বাহিনী যশোর শহরের আশেপাশে পৌঁছে যায়। যুগান্তর পত্রিকায় ৫ ডিসেম্বর প্রথম পাতায় একটি নিউজের শিরোনাম ছিল-‘পশ্চিমবঙ্গে পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হবে-লে.জে. অরোরা’। রিপোর্টে বলাহয়-‘বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় বাহিনীর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আজ সাংবাদিকেদের বলেছে, পূর্ববঙ্গ দখল করা ভারতীয় বাহিনীর উদ্দেশ্য নয়। এ সম্পর্কে আমার সরকারের নীতি খুবই পরিষ্কার। আমার সরকার চান, বাংলাদেশে যথার্থ জনপ্রতিনিধিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক। তিনি আরও বলেন, তার অনুমান বাংলাদেশে যে চার ডিভিশন সৈন্য রয়েছে, তারমধ্যে দুই ডিভিশন সৈন্য রয়েছে যশোরে। আমরা যে কোন মুহুর্তে যশোর শহরে ঢুকবো। যশোরের পশ্চিমে ভারত সীমান্তের বয়রা এলাকায় সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তিনি বলেন, গত দু’মাসে তারা যে কৃতিত্ব দেখিয়েছে তা তারিফ করার মত।
ভারতীয় বাহিনী মুক্তিফৌজকে কোন রকম সাহায্য করেছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তাদের কোন সাহায্য দেয়নি। তবে আমি এ বিষয়ে নি:সন্দেহ যে, আমার সরকার শিঘ্রই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলে মিশে একই কমান্ডের অধীনে কাজ করা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবেন।
লে. জেনারেল অরোরা আরও জানান, ভারতীয় বাহিনীর সর্বাধ্যক্ষ জেনারেল মানেকশ গতকাল বিকালে কলে তাকে জানিয়েছেন যে, পাকিস্তানিরা পশ্চিম রণাঙ্গণে কয়েকটি বিমান ঘাঁটিতে বিনা প্ররোচনায় আগ বাড়িয়ে আক্রমণ চালান।
সামরিক বাহিনীর এক মুখপাত্র বলেন, সাতক্ষীরা এলাকায় ভারতীয় সৈন্যরা সারাদিন ধরে টহল দেয় এবং সারাদিন ধরেই প্রায় গোলাগুলি ছোড়ে। ওই এলাকার আকাশে দুটি পাকিস্তানি স্যাবার জেট বিমানকে দেখা গেলে তাড়া দেয়া হলে বিমান দুটি পুব দিকে চলে যায়।
আজ দিনের বেলায় সড়ক ও রেল যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি দর্শনাকে ভারতীয় সৈন্যরা দখল করে নেয়। ওখানে পাকিস্তানি সেনারা ১৮ নম্বর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি ও কিছু আধা সামরিক বাহিনী ছিল। দর্শণার সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় একশ’ সৈন্য মারা যায়। এখানে ভারতীয় সেনারা বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র -গোলাবারুদ, দুটি ডিজেল ইঞ্জিন ও দশটি বগি দখল করে।
একই দিন সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী গ্রাম পুষ্পকাঠিতে এসেছিলেন যুগান্তরের সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত। তিনি লেখেন, ‘পাকিস্তান আজ ট্যাঙ্কের সাহায্যে ব্রিগেডের শক্তি নিয়ে পারুলিয়া পুনরুদ্ধারের জন্য সকালে প্রবল আক্রমণ চালায়। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর গোলা তাদের আক্রমণকে বার বার প্রতিহত করে। বেলা আড়াইটা নাগাদ ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুইট হান্টার বিমান যখন এই সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে আসে এবং পাকিস্তানি ট্যাঙ্কের উপর হামলা চালায়, তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়।
যখন এই ঘটনা ঘটে তখন কলকাতার দুই জন সাংবাদিক সাতক্ষীরা থেকে প্রায় ৫ মাইল দূরে পুষ্পকাটিতে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি ফৌজের উপর ভারতীয় হান্টার বিমানের আক্রমণ দেখেন। আমাদের সঙ্গে কয়েকশ’ বাংলাদেশের নাগরিক হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠেন।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক