কল্যাণ ডেস্ক: ঈদের আগে সয়াবিন তেল সংকটে ভোক্তাদের টনক নড়েছে। এ সময় অনেকেই সয়াবিন তেলের বিকল্প খুজতে শুরু করেন। এ ক্ষেত্রে একাংশ ক্রেতা সয়াবিন ছেড়ে সরিষার তেলের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছেন। যার ফলে বেড়ে গেছে সরিষার তেলের দাম।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বিশ্বে যত ভোজ্যতেল ব্যবহার হয়, তার ৬০ শতাংশের জোগান দেয় সয়াবিন তেল। দেশে দৈনিক ভোজ্যতেলের চাহিদা ৫ হাজার ৪৭৯ টন। এর ৯০ শতাংশের জোগান আসে আমদানি করা সয়াবিন থেকে। বাকিটা সরিষা, সানফ্লাওয়ার অয়েল, রাইস ব্র্যান অয়েলসহ অন্যান্য উৎস থেকে আসে। এই বিকল্পগুলো থেকে সম্মিলিতভাবে বছরজুড়ে তেল পাওয়া যায় মাত্র ২ লাখ ৩০ হাজার টন।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩৭ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। হেক্টরে ১.৩৬ টন গড় ফলন হিসেবে ৭ লাখ ৯৯ হাজার ৮৪১ টন সরিষা উৎপন্ন হয়।
কয়েক দশক আগেও দেশের বাজারে সরিষার তেল ছিল শীর্ষে। তবে সয়াবিন আমদানির পর থেকে সরিষার তেলের জায়গা দখল করে নিয়েছে সয়াবিন তেল।
মূলত করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজারনীতি এবং সরিষার তেলের তুলনায় দাম কম হওয়ার কারণে দেশের ৯৫ ভাগ ক্রেতা এখন সয়াবিন তেলের ভোক্তা হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে দাম বেশি হওয়ায় সরিষার তেল পরিণত হয়েছে শৌখিন পণ্যে।
তবে সয়াবিনের সংকট দেখা দেওয়ায় সরিষার দিকে যেই-না ঝুঁকতে শুরু করেছেন ভোক্তারা, তখনই বেড়ে গেছে সরিষার তেলের দাম। কয়েকদিন আগেও লিটারপ্রতি সরিষার তেল বিক্রি হয়েছে ২৮০-২৯০ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫০-৩৬০ টাকা।
বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, সয়াবিনের অস্থিরতা তৈরির আগে প্রতি লিটার খোলা সরিষার তেলের দাম ছিল ১৮০-২০০ টাকা পর্যন্ত। রোজার আগে এ দাম বেড়ে ২২০-২৪০ টাকায় গড়ায়।
ঘানি ভাঙা তেল রোজার আগে ছিল ২৬০-২৮০ টাকা পর্যন্ত। এখন সয়াবিনের মারাত্মক ঘাটতিতে প্রচণ্ড রকম চাপ পড়েছে সব ধরনের সরিষার তেলের ওপর। এতে আরেক দফা দাম বাড়ে ঘানিতে ভাঙা সরিষারও। বর্তমানে এই তেল স্থানভেদে ৩২০-৩৬০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বুধবার (১১ মে) উত্তর বাড্ডা খুচরা বাজারের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাসখানেক আগেও সরিষার তেল ছিল একটি শৌখিন পণ্য। বিশেষ করে আচার তৈরি, ভর্তা ও শরীরে মাখার জন্য সরিষার তেল ক্রয় করতেন ক্রেতারা। তবে ঈদের কয়েকদিন আগে সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দেওয়ায় সরিষার তেল কিনতে শুরু করেন তারা। এ সুযোগে কোম্পানিগুলো ও পাইকারি সরিষার তেল বিক্রেতারা বাড়িয়ে দিয়েছে দাম।
বাজারে সরিষার তেল কিনতে আসা একজন ক্রেতা জানান, রোজার শুরু থেকেই তিনি সরিষার তেল খেয়ে আসছেন। এটির স্বাদ সয়াবিন তেলের থেকে কম নয়; বরং ঝাঁজে ও গন্ধে অতুলনীয়। তবে বুধবার (১১ মে) বাজারে এসে তিনি দেখেন, রোজায় যে সরিষার তেলের দাম ছিল লিটারপ্রতি ২৭০ টাকা, কদিনের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫০ টাকায়।
এদিকে মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতেও প্রতি মণ সরিষার দাম ছিল মানভেদে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত। এখন সেই সরিষা বাজারে বা কৃষক পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায়।
বাজারে বর্তমানে রাঁধুনি, তীর, ফ্রেশ, সুরেশ, পুষ্টি, রূপচাঁদা ছাড়াও কমপক্ষে ২০টিরও বেশি ব্র্যান্ড ও নন ব্র্যান্ডের সরিষার তেল বিক্রি হচ্ছে।
দাম বৃদ্ধি সম্পর্কে এসব কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা জানান, চাহিদা বাড়লে দাম বৃদ্ধি পাবে। এ নীতিতেই বাজারে সরিষার তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে ভোক্তাদের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সরিষার তেল কতখানি কার্যকর হবে, তা নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। কেননা, দেশে যত সরিষা উৎপাদিত হয়, তার পুরোটাই তেল হয়ে বাজারে আসে না।
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ক্রপস উইং শাখার তথ্যানুযায়ী, বছরওয়ারি ফলন যাই হোক, বীজ সংরক্ষণসহ সরিষার অন্যান্য ব্যবহার বাদ দিয়ে প্রতিবছর গড়ে ৫ লাখ টন সরিষা ব্যবহার হয় তেল উৎপাদনে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের তথ্য বলছে, সরিষা বীজে সাধারণত ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত তেল থাকে। এ হিসাবে এক কেজি সরিষা থেকে পাওয়া যায় ৪০০ গ্রাম তেল। ৪০ কেজি বা এক মণ সরিষা থেকে তেল মেলে ১৬ কেজি।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রতিবছর ৫ লাখ টন সরিষা থেকে গড়ে ২ লাখ টন তেল পাওয়া যায়। বিপরীতে সারা বছর দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ টন। সয়াবিনের বিকল্প হিসেবে যদি ভোক্তারা সরিষার তেল কিনতে শুরু করেন, তাহলে মজুত করা সরিষার তেল দিয়ে মাত্র ৩৭ দিনের চাহিদা মিটতে পারে।