সুনীল ঘোষ
আমরা যা ভাবিনি, অনেকেই যা ভাবতে চান না; ইতিহাস ভুলে থাকতে পছন্দ করেন কিংবা লজ্জাবোধ করেন, তাদের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে শিশু সাজ্জাদ। ১০ বছরের এই শিশু লাল-সবুজের ফেরিওয়ালা সাজ্জাদের কথা।
বিজয়ের ৫১ বছরে পা রেখেছে বাঙালি জাতি। কিন্তু শিশু সাজ্জাদের ধারণা মুক্তিযুদ্ধের রক্তরঞ্জিত ইতিহাস অনেকেই জানে না। জানে না মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃতি ইতিহাস। লাল-সবুজের পতাকার মর্যাদাও দেয় না। তাই বছর ঘুরে বিজয়ের মাস ও স্বাধীনতার মাস আসলেই লম্বা বাঁশের লাঠিতে লাল-সবুজের পতাকা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শহর-বন্দর ও গ্রাম-গঞ্জে। এবার দলে ভিড়িয়েছে নয়ন ও প্রান্ত নামে আরও দুই শিশুকে। তারা সর্বত্র; সর্বমহলে ছড়িয়ে দিতে চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
শিশুর পুরো নাম সাজ্জাদ ব্যাপারী। নয়ন ও প্রান্ত মজুমদার তার প্রতিবেশি বন্ধু। বাড়ি খুলনার সোনাডাঙার নবপল্লীতে। শনিবার যশোর টাউনহল ময়দানে কথা হয় এই ৩ শিশুর সাথে। এ বয়সে স্কুলে না যেয়ে ফেরিওয়ালা কেন প্রশ্ন করা হলে শিশু সাজ্জাদ জানায়, রুটি-রুজির জন্য পতাকা বিক্রি করি না। বাপ-মা ও দাদা-দাদীর মুখে শুনেছি যুদ্ধ করে দ্যাশটা পাইছি। স্বাধীন হইছি এ মাসেই। গান শুনেছি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে—, মুজিব তুমি বাইয়া যাও-রে। তাছাড়া মা কইছে এ মাস রক্তে রাঙানো। কিন্তু অনেক মানুষ তা মনে রাখেনি। তাই ৩ বছর ধরে মার্চ ও ডিসেম্বর মাসে পতাকা বিক্রি করি। সবার হাতে লাল-সবুজের পতাকা তুলে দিয়ে মনে করাইতে চাই-দ্যাশটা এমনি এমনি করে আসে নাই; যুদ্ধে বুকের রক্ত ঢেলে যারা এনে গ্যাছে দ্যাশটা; তাদের স্মরণ করি।
শিশু প্রান্ত ও নয়নও মনে করে- লাল-সবুজের পতাকার মর্যাদা অনেকেই জানে না। জানলেও মর্যাদা দেয় না। তাই ভুলে যাওয়া মানুষগোর মনে করাইতে পতাকা বিক্রি করি। লাল-সবুজের এই তিন ফেরিওয়ালা প্রতিদিন খুলনা থেকে যশোরে আসে, রাতেই আবার ফিরে যায় ট্রেন ধরে। তাদের সাথে কথোপকথনে বুঝা যায়, সত্যিই তারা শুধু রুটি-রুজির জন্য না, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এসব শিশু নাম লিখিয়েছে লাল-সবুজের ফেরিওয়ালার দলে।
বিজয়ে ৫১ বছর ঘিরে দেশজুড়ে চলছে বিজয় উৎসব। সত্যিই তো; মার্চ-ডিসেম্বর; টানা ৯ মাস সশস্ত্র রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতা। মুক্তিকামী বাঙালি বুকের তরতাজা রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছিল লাল-সবুজের পতাকা। স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাসে লাল-সবুজের ভালবাসায় বর্ণিল হয়ে উঠে সবকিছু।
দলবেঁধে ফেরিওয়ালাদের পথচলায় এক অন্যরকম পরিবেশ বিরাজ করে শহর-বন্দর থেকে শুরু করে গ্রাম-গ্রামান্তরে। এসব ফেরিওয়ালাদের কাঁধে আমাদের জাতীয় পতাকার সারি দেখলে মনে হয় লাল-সবুজের ভালবাসা পুরো নাগরিক জীবনকে ওরা ছুঁয়ে দিয়েছে। এদের কারণেই সবে পায়ে হাঁটা অবুঝ শিশুও পতাকা হাতে ধরে আনন্দ করে।
এসব শিশুর মধ্যে দেশপ্রেম আসতে বাধ্য বলেও মনে করেন পঞ্চাশোর্ধ বয়সের ফেরিওয়ালা সানোয়ার হোসেন। প্রতি বছরের মতো এবার তিনি যশোরে এসেছেন পতাকা বেচতে। তিনি ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকার বাসিন্দা। তিনি বলেন- পতাকা বিক্রি করে আমার সংসার চলে ঠিকই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেয়াই মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য।
এরা বিপুল সংখ্যক নানা সাইজ ও আকারের পতাকা আনে। মাথা ও কপালজুড়ে লাল-সবুজ এঁকে দিতে আনেন লাল-সবুজের ফিতা। শিশু, কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসী বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ এসব কিনে পড়েন। এরমধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস।