নিজস্ব প্রতিবেদক: যশোরের ভবদহ সমস্যা সমাধানে ছয় দফা দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি। মঙ্গলবার দুপুরে যশোর কালেক্টরেট চত্বরে মানববন্ধন শেষে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
স্মারকলিপিতে ভবদহ সমস্যা সমাধানে যে ছয়দফা দাবি জানানো হয়েছে, সেগুলো হলো- ক্রাস প্রোগ্রামে মাঘি পূর্ণিমার আগে বিল কপালিয়ায় টিআরএম চালু ও ডেল্টা প্লান-২১০০ এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে; ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার সেচ প্রকল্প ও প্রস্তাবিত প্রায় ৪৫ কোটি টাকার ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ’ অবিবেচনাপ্রসূত সেচ প্রকল্প বাতিল করতে হবে; আমডাঙ্গা খাল সংস্কার কাজ দ্রুত করতে হবে। প্রি-ওয়ার্ক ও পোস্ট ওয়ার্ক জনসমক্ষে টাঙিয়ে দিতে হবে।
কাজের স্বচ্ছতা নিরূপণে আন্দোলনকারী সংগঠন ও জনপ্রতিনিধি ও সেনাবাহিনীকে সংশ্লিষ্ট করে তদারকি কমিটি গঠন করতে হবে; জনপদের ফসল, বাড়িঘরসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, কৃষি ঋণ মওকুফ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ; সরকারকে মিথ্যা তথ্য প্রদান, নদী হত্যা, জনপদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা, ফসল, বসতবাড়ি ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতির সাথে জড়িত পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; এবং ভবদহ সমস্যা স্থায়ী সমাধানে উজানে মাথাভাঙ্গা নদীর সাথে ভৈরব নদের সংযোগের প্রস্তাবিত প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
এর আগে যশোর কালেক্টরেট চত্বরে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ ও মানববন্ধন করেন ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ। সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ, আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালী, যুগ্ম আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী আব্দুল হামিদ, সদস্য সচিব অধ্যক্ষ চৈতন্য কুমার পাল, শিবপদ বিশ্বাস, অনিল বিশ্বাস, রাশিদা বেগম, রাজু আহম্মেদ, নাজিম উদ্দিন, জিল্লুর রহমান ভিটু, তসলিম-উর-রহমান, হাসিনুর রহমান প্রমুখ।
সমাবেশ শেষে যশোরের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। স্মারকলিপি গ্রহণ করেন জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান। পরে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রতিনিধি দল ঘটনা ও বর্তমান পরিস্থিতি তাকে অবহিত করেন।
স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, ভবদহ জনপদের ২০০ গ্রামের প্রায় প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে ১০ লাখ মানুষ একটি কুচক্রি সিন্ডিকেটের লুটপাটের লালসার শিকার হয়ে স্থায়ীভাবে পানির তলে তলিয়ে যেতে বসেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, ঠিকাদার, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও ঘের মালিকেরা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে প্রতি বছর জনগণকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা লুটের স্থায়ী ব্যবস্থা করে নিয়েছে। তাদের কাছে ভবদহ হলো- ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’।
আরও বলা হয়েছে- দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকার আয়োজিত এক কনভেনশনে নীতিগতভাবে ভবদহ অঞ্চলের বিলগুলোতে পর্যায়ক্রমে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট-জোয়ারাধার প্রকল্প) প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।
সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০২ সালে বিল কেদারিয়ায় এবং পরবর্তী বিল হিসাবে ২০০৬ সালে বিল খুকশিয়ায় টিআরএম এর সফলতায় স্রোতের ভরবেগ বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্রুত নদীগর্ভের পলি কেটে কাট পয়েন্ট থেকে নদী ২৫/৩০ ফুট গভীর ও মোহনা সচল হয়েছিল। পরবর্তী নির্ধারিত বিল কপালিয়ায় টিআরএম কার্যকর করতে গেলে প্রকাশ্য দিবালোকে সশস্ত্র আক্রমণে ২০১২ সালে হুইপ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা আহত হন এবং সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে টিআরএম প্রকল্প বাতিল করে দেয়। ফলে ওই চক্র ও সিন্ডিকেট স্থায়ী লুটপাটের সরকারি মদদ পেয়ে বসে।
পুনরায় নিরঙ্কুশ জনমতের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রীসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি জাতীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এবং আইডব্লিউএম কর্তৃক ব্যাপক জরিপ ও জনমত যাচাই করে প্রস্তাবিত বিল কপালিয়া ও পর্যায়ক্রমে বিলে টিআরএম প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যা ডেল্টা প্লান ২১০০ এর সুপারিশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পানিসম্পদ মন্ত্রী ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে পুণঃপর্যালোচনার পর পানিসম্পদ মন্ত্রী টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের রোষালনে পড়ে।
২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আকর্ষিকভাবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ওই প্রকল্প বাতিল করে নতুন প্রকল্প প্রণয়নের নির্দেশ দেয়। এরপর হঠাৎ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ভবদহ গেটে এসে টিআরএম হবে না এবং ওই বিলগুলোকে জলাভূমি হিসাবে ঘোষণা দেন। তিনি ডেল্টা প্লান-২১০০ এর অজুহাত উত্থাপন করেন। উপস্থিত জনগণের মধ্যে আপত্তি উঠলে তিনি তাদের সাথে অশোভন আচরণ করেন।
প্রকৃত সত্য হলো- ভবদহ এলাকা কখনই জলাভূমি বা জলাশয় ছিল না। এমন তথ্য রাষ্ট্রীয় নথিপত্রেও দেখা যায় না। বরং ডেল্টা প্লান-২১০০ এ ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ রয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড ডেল্টা প্লান-২১০০ এর বৈজ্ঞানিকভাবে যথার্থ সুপারিশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরকারকে মিথ্যা তথ্য প্রদান করছেন এবং জনমতকে উপেক্ষা করে পাম্পের মাধ্যমে সেচ দিয়ে জলাবদ্ধতা মুক্ত করার অবিবেচনাপ্রসূত প্রকল্প দিয়ে অর্থ অপচয় করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড মিথ্যা তথ্য প্রদান করে বলেছে যে, এবার পাম্পের মাধ্যমে সেচ দেওয়ার ফলে এলাকায় ব্যাপক ফসল উৎপাদন এবং এবার এলাকা জলাবদ্ধ হয়নি, মানুষের বাড়িঘর-রাস্তা এবং কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠেনি।
আবারো পানি উন্নয়ন বোর্ড জনমত উপেক্ষা করে ৩ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছে এবং ৪৫ কোটি টাকার সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে যে অর্থ সম্পূর্ণ অপচয় হবে এবং বরাবরের মতো জনদুর্ভোগ মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের বরাদ্দ একনেকে পাস হলেও বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে অহেতুক বিলম্ব করে গণদুর্ভোগ জিইয়ে রাখা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনৈতিক জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে ২১ ভেন্ট থেকে বারোয়াড়ি মোহনা পর্যন্ত ৫০-৬০ কিলোমিটার নদী হত্যা করা হয়েছে। তাদের ভূমিকা সরকারের বিরুদ্ধে উষ্কানিমূলক। ফলে অনভিপ্রেত যে পরিস্থিতির উদ্ভব হতে যাচ্ছে তার সমস্ত দায় তাদেরকেই নিতে হবে। এই গণবিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রের দায় সরকারের উপরেও বর্তাচ্ছে।